নজরুলের জানলা


Author / কলম : Priyanka Ghosh

Wednesday, May 31, 2023

গতকাল নজরুল জয়ন্তী গেল, অনেক লেখালেখি আঁকাআঁকি গানবাজনা হল। আসলে পুরো বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ জুড়েই তো বাঙালির টানা উৎসব - শুরু হয নববর্ষের বর্ষবরণ দিয়ে, তারপর একে একে আসে বাঙালির তিন মহারথীর জন্মজয়ন্তী - সত্যজিৎ, রবিঠাকুর, নজরুল; মাঝে সুকান্ত আর রামমোহন রায়ের প্রয়াণ আর জন্মদিন, যথাক্রমে। ফাঁকে ফাঁকে পেরিয়ে যায় অক্ষয় তৃতীয়া, জামাই ষষ্ঠী ইত্যাদি। ভগবান বুদ্ধ যদিও ঠিক বাঙালি নন, কিন্তু আমরা তাঁকেও আপন করে নিয়েছি!
তো যাক, যেকথা বলছিলাম - এই নজরুলের জন্মদিনে আমার আবার সেই মেয়েটার কথা লিখতে ইচ্ছে করল; ওই যে গো - যার বোকামি আর পাগলামির গপ্প আগেও শুনিয়েছি বারদুয়েক, ভাষাদিবস আর নারীদিবসে।
আগেই বলেছি, মেয়েটা থাকত উত্তর কলকাতার গলির গলি তস্য গলিতে, কিন্তু বড় বড় চোখে স্বপ্ন দেখত আকাশজোড়া। আমগাছ আর বটগাছের ফাঁক গলে উঁকিমারা চৌখুপি গরাদদেওয়া আকাশে ততধিক বড় বড় চোখওয়ালা ঝাঁকড়া চুলওয়ালা এক কবির "সংকল্প"র স্বপ্ন!
"থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে,
দেখব এবার জগৎটাকে"
কবিতাটা যে তিনদশক পরে ওকে কি মারাত্মকরকম সংক্রমিত করবে, মেয়েটা তখন সেটা জানতো না যদিও!
যাহোক, কবিতাটা মুখস্থ করতে দিয়েছেন বাংলা দিদিমণি - মেয়েটা জোরে জোরে দুলে দুলে পড়ছে, বাবা বল্লেন, "নজরুলকে আমি দেখেছি জানিস?"
মেয়েটার বিশ্বাস হল না - ওসব পড়ার বইয়ের কবিটবিরা কি সত্যিকারের মানুষ নাকি!
অবিশ্বাসের চোখে তাকালো বাবার দিকে।
বাবা আবার বল্লেন, "পাশের পাড়ার শেষ থেকে পাঁচ নম্বর বাড়িটাই তো নজরুলের - শেষের দিকটায় পাগল পাগল হয়ে গেছিলেন, ঘোলাটে হলদে চোখ, জানলায় বসে থাকতেন সারাক্ষণ, পাড়ার ছেলেছোকরারা পিছনে লাগতো।"
মেয়েটার মোটেই বিশ্বাস হল না - যে কবি লিখতে পারে "বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে", সে কিনা একটা জানলার গরাদ ধরে সারাদিন বসে রাস্তা দেখত! যাহ, বাবা নির্ঘাৎ বাজে কথা বলছে। ঘাড় তুলে রিনরিনে বিদ্রোহিনী গলায় দাবি জানালো, "কই তাহলে আজ বিকেলে নিয়ে চলো আমায়, সেই জানলাটা দেখাও।"
বাবা কথা দিয়ে কাজে বেরিয়ে গেলেন। যথারীতি বিকেলবেলা দুমুঠোয় বাবা আর জ্যাঠতুত দাদার হাত ধরে কৌতূহলী মেয়েটা দেখতে চলল 'নজরুলের জানলা' -
'ওমা তাইতো! বাবা তো মিথ্যে বলেনি... জানলাটা সত্যিই আছে যে!'
একদম ওদের বাড়ির মতই সাদামাটা রংচটা একটা বাড়ি। সদর দরজায় তালা নেই, শুধু ভেজানো - ঠেলা দিলেই খুলে যায় - অনেক শরিকের বাসা! দরজা খুলেই একটা অন্ধকার সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে, দিনের বেলাতেও কোনও আলো ঢোকে না এখানে। নিচের দেয়ালে আর কোন জানলা নেই, শুধু দোতলায় একটা গরাদদেওয়া সবুজরঙের পাল্লাওয়ালা জানলা - যেখান থেকে কলকাতার, তথা ভারতের, সবচেয়ে বড় জলের ট্যাংকটা দেখা যায়। দেওয়ালের বাইরে কালো রঙের একটা ক্ষয়ে যাওয়া বোর্ড - একটু কাত হয়ে ঝুলছে, তাতে সাদা চকে নাম লেখা "কল্যাণী কাজী, অরিন্দম কাজী"।
মেয়েটা এই নামগুলো চেনে না, কিন্তু কাজী পদবীটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হল।
এরপর আরো অবাক কান্ড - জেঠতুত দাদা লম্বা লম্বা পায়ে অন্ধকার সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেল - মেয়েটাও হাতড়ে হাতড়ে দাদার পিছনে সিঁড়ি চড়তে লাগল। অদম্য কৌতুহলে গলা শুকিয়ে গেছে, 'ওখানে কি এখনও সেই সুন্দর চোখের কবি বসে আছে?'
দরজা খুললেন খুব সুন্দর সাজগোজ করা এক মহিলা - বহুবছর পরে যাঁর হাত থেকে এই মেয়েটাই মাধ্যমিকে আঞ্চলিক প্রথম হয়ে পুরস্কার নেবে পাড়ার অনুষ্ঠানে। কিন্তু তখন তো সেসব জানা নেই, মেয়েটা ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক খুঁজল - কবিকে দেখা যায় কিনা! না কবি নেই, তবে তাঁর অনেক ছবি আছে দেয়ালে। গিটার হাতে আরেকটা দাদা ঘর থেকে বেরোলো - সে নাকি কবির নাতি, মেয়েটার দাদার বন্ধু!
ওই মহিলা দাদাকে জিজ্ঞেস করলেন, "ও কি আবৃত্তি শিখবে? তাহলে নাম লিখিয়ে যাও।"
মেয়েটার কিরম যেন অস্বস্তি হতে থাকে - এরা যে বড্ড সাধারণ, কিছুতেই ওই ঝাঁকড়াচুলো দীঘলচোখা কবির জগৎদেখার স্বপ্নের সাথে মেলাতে পারে না এই সাদামাটা ঘরোয়া ছবিটা।
ছুটে নেবে আসে নিচে। আর যায়নি কোনোদিন ওই বাড়িটার ভিতরে।
তবে আগামী বছরদশ রোজকার আসাযাওয়ার ফাঁকে প্রত্যেকদিন তাকিয়ে দেখেছে গরাদদেওয়া সবুজ জানলাটা - প্রত্যেকবার একটা শিহরণ খেলেছে শিরদাঁড়া বেয়ে, মনে হয়েছে কানে কানে কে যেন বলছে,
"আমার সীমার বাঁধন টুটে,
দশ দিকেতে পড়ব লুটে,
পাতাল ফুঁড়ে নামব নীচে,
উঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে "!